প্রকাশিত: Fri, Dec 8, 2023 10:12 PM
আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 8:16 PM

আহমদ ছফা, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ও হিন্দু-মুসলিম জমিদার

 কুলদা রায় : আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামে একটি আর্টিকেল লিখেছেন ১৯৭৭ সালে। তিনি লিখেছেন, বাঙালি মুসলমানেরা আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। এ অঞ্চলে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার পরে সে যে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, এদের হতে হয়েছিল তার অসহায় শিকার। যদিও তারা ছিলেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তথাপি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রশ্নে তাদের কোনো মতামত ছিল না বা বক্তব্য ছিল না। আহমদ ছফার এই তথ্যটি সত্য। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়Ñএর মধ্যে অর্ধসত্যও আছে। সেটা হলো, এই নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী বলতে তিনি শুধু মুসলমানদের বোঝাচ্ছেন। মুসলমানদের বাইরেও যে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী ছিল বা আছে তা গোপন করছেন।

বাঙালিদের মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করেছে এদেশে মূলত তুর্কীদের আগমনের পরে। এর আগে শশাঙ্ক নামের একজন অজ্ঞাতকুলশীল রাজার অধীনে বাংলা ভূখণ্ড ছিল। সে সময়ে যেসব মানবগোষ্ঠী ছিল তারা কিন্তু পুরোপুরি বৈদিক হিন্দু ছিল না। তারা  অনার্য হিসেবে নানা প্রাকৃতিক শক্তির পুজো করত। তাদের মধ্যে কৃষির উর্বরাশক্তির প্রতীক হিসেবে শিব-লিঙ্গের পুজা করা হত। এই শিব হিন্দুদের শিব নয়। আর্যরা যখন এই ভারত ভূখণ্ডে এলোÑঅনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তাদের পরাভূত করতে হিমসিম খাচ্ছিলো তখন আর্য ও অনার্যদের মধ্যে একধরনের সমন্বয় হলো। আর্যরা অনার্যদের শিবকে মহাদেব হিসেবে গ্রহণ করল। আবার আর্যদের দেবী দুর্গাকে এই শিবের সঙ্গে মিলিয়ে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে একীভূত করলো। 

বাংলা ভূখণ্ডে যারা সে সময় অধিবাসী ছিলেন তারা পেশায় জাইলা আর হাইলা। ফলে তারা অতি ছোটোজাত। বাংলা ভূখণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো খারাপ যে আর্যদের এই ভূখণ্ডে আসতে বিলম্ব হল। তারা অনেকটাই এড়িয়ে চলল। ফলে রামায়ন-মহাভারতে বাংলা ভূখণ্ডের কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ পাল রাজাদের সময়ে এই হাইলা-জাইলাদের বন্যা-খরা, ঝড়, বাদল,মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দস্যুদের কবলে অতি দীনহীন জীবন কাটাতে দেখা যায়। মহামতি গৌতম বুদ্ধের অহিংস ব্রতকে অনুসরণ করে যখন পাল রাজাদের আমলে জলক্ষেত্র থেকে মাছ ধরা নিষেধ করা হল  তখন প্রজাদের ক্ষোভ সৃষ্টি হলো রাজার বিরুদ্ধে। 

তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল রাজার বিরুদ্ধে। ইতিহাসে এটা কৈবর্ত বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত। তখনও   রাজারা নত হয়ে প্রজাদের কথা মানতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রজাদের মধ্যে বৌদ্ধের বাণী প্রচারিত হচ্ছে। তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তখনো বাংলায় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অতি নেই বললেই চলে। থাকলেও তারা গোণার মধ্যে পড়ে না। 

আবার দাক্ষিণাত্য থেকে যখন সেন রাজারা এলেন, তারা দেখলেন এই ভূখণ্ডে মনুর অনুশাসনে মানা বৈদিক হিন্দু নেই। রামায়ন-মহাভারত-গীতা নামের বিষয় নেই। তারা যাগ যজ্ঞ হোম পুজার এগুলোর কিছুই জানে না, তাদের প্রকৃতির ভয় দেখানো যায় বটে—কিন্তু নরকের ভয় দেখানো যায় না, স্বর্গের লোভে বশীভূত করা যায় না। ফলে সেন রাজারা কনৌজ থেকে দরিদ্র ব্রাহ্মণদের নিয়ে এলেন এই ভূখণ্ডে। তাদেরকে একই লপ্তে ভূমি দান করা হল। দ্রুত তাদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়া হল। তাদেরকে বলা হল—এই অনার্যদের পুরোহিতগিরি করো। 

তাদের হিন্দু শেখাও। তাদের উপরে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করো। বৌদ্ধদের তখন মেরে ধরে তাড়িয়ে দেওয়া হল বাংলা ভুখণ্ড থেকে। তাদের এই পলায়ণপর দশা দেখিয়ে অনার্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিক ধর্মের অনুগত করা হল। বলা হল—তোমরা হলে শুদ্র। তোমারদের জন্ম ব্রহ্মার পা থেকে। নিচু জাত। ব্রাহ্মণদের সেবা করাই তোমাদের মূল কাজ। এটাই তোমাদের ধর্ম। এভাবেই তোমাদের মুক্তি। নাহলে তোমাদের একালের জমি-জিরেত যাবে। পরকালে পার্মানেন্ট নরক আসবে। 

এভাবে তাদেরকে বর্ণাশ্রমের শিকড়ে বন্দী করে ফেলা হল। এইভাবে রাজন্যবর্গ এবং তাদের অনুগত নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদিদের অত্যাচারে পীড়িত হয়ে নিপীড়িত মানবগোষ্ঠী একটা আত্মরক্ষার উপায় খুঁজছিল। যখন তুর্কির ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি দুইশত ঘোড় শোয়ার নিয়ে বঙ্গ নামের ভূখণ্ডে ভাগ্যান্বেষণে এলেন তাদেরকে এই নীপিড়িত প্রজাদের একটি অংশ স্বাগত জানাল। সেন রাজাদের পরাজয় তরান্বিত হল। 

নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর একটি অংশ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করল। এছাড়া তাদের উপায় ছিল না। আর বাকি বৌদ্ধ, নমোশুদ্র নামের মানবগোষ্ঠীরা স্বধর্মেই অটল থাকল। মুসলমান শাসক গোষ্ঠী এলে নও মুসলিমরা কিছুটা  রাজ-অনুগ্রহ পেলেও হিন্দু বা বৌদ্ধদের সেটা জোটার কথা নয়। সে যোগ্যতা তাদের ছিল না। অথচ ব্রহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য নামের বৈদিক হিন্দুরা দক্ষতার গুণে এই মুসলমান-রাজাদের শাসনকার্যে নিয়োজিত হল। এই নির্যাতিত শুদ্র বা বৌদ্ধদের কথা আহমদ ছফা বলছেন না। এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি বয়ান করছেন এই নিপীড়িত বাঙালী মুসলমান জনগোষ্ঠী নির্যাতিত হয়েছে হিন্দু কর্তৃক। যেকালের হিন্দু কর্তৃক নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে সেকালে ব্রাহ্মণরা শাসন ক্ষমতায় বা অর্থসম্পদের উঁচু পর্যায়ে থাকলেও জনসংখ্যার ভিত্তিতে তারা ছিল নগণ্য। ফলে নিপীড়নের দায় হিন্দুদের উপর চাপালে শুদ্রদের ঘাড়েও এসে পড়ে। অথচ ইতিহাসে এই শুদ্ররাই মুসলমানদের চেয়েও সর্বকালে সর্বাধিক নিপীড়ণের শিকার হয়ে আসছে। তার তুলনা মেলা ভার।

সব ব্রাহ্মণই কি নিপীড়ক ছিল? সামাজিক ইতিহাস বা সাহিত্য কিন্তু তা বলে না। যে ব্রাহ্মণ জমিদার ছিলেন তিনিই হয়তো নিপীড়ক ছিলেন। কিন্তু তার অধীনে যেসব প্রজা ছিল তার মধ্যে ছিল অসংখ্য ব্রাহ্মণ। তারা ছিলেন অতি দরিদ্র। পথের পাঁচালীর হরিহর, সর্বজয়া, অপু, দুর্গাদের মতো হতভাগারা। তারা কী করে নিপীড়ক হয়? ছফা এই জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি এক নিপীড়ক জমিদারের দায় সব দরিদ্র ব্রাহ্মণের কাঁধেও চাপাচ্ছেন। জমিদার বলতেই যদি নিপীড়ক হয় তবে হিন্দু জমিদার যেমন নিপীড়ক , ঠিক তেমনি মুসলমান জমিদাররাও নিপীড়ক ছিলেন। ছফা শুধু হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধেই তার ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।  ছফার এই বয়ানের মধ্যে একটি ষড়যন্ত্র আছে। ফেসবুকে ৬-১২-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।